রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চতুর্থ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পথে সামনে যখন ২০২৬, তখন প্রশ্ন একটাই— এ যুদ্ধ কি শেষের দিকে, নাকি আরও দীর্ঘ ক্ষয়িষ্ণু অধ্যায় অপেক্ষা করছে? কেউ বলছেন, শান্তি প্রচেষ্টায় সর্বোচ্চ অর্জন হবে যুদ্ধে একটি সাময়িক বিরতি; আবার কেউ দেখছেন সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির সম্ভাবনাও। আবার অনেকে সতর্ক করছেন, ভূখণ্ডে ছাড়, বৈশ্বিক শক্তির পালাবদল ও রাজনৈতিক চাপ সব মিলিয়ে যুদ্ধ আরও জটিল হতে পারে। তাই শেষ কবে হবে তার চেয়ে বড় প্রশ্ন এখন, কোন শর্ত আর কোন পথে শেষ হবে এই যুদ্ধ।
সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বলছে, কিয়েভের ঐতিহাসিক সোফিয়া স্কয়ারে আছে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় ক্রিসমাস ট্রি। সেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাহত রুশ সেনাদের নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন ভাসিলি নামে ইউক্রেনের এক কর্মকর্তা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি তাদের ট্রেঞ্চে ঢুকেছি। ওরা সত্যিই আমাদের ভয় পায়।’
কিন্তু রুশ সেনাদের এই ভয় মানে এই নয় যে যুদ্ধের শেষটা ঠিক করে দিতে পারবে কিয়েভ। কারণ রাশিয়ার সৈন্যসংখ্যা বেশি, অর্থনীতি শক্তিশালী এবং যুদ্ধের জন্য অর্থভাণ্ডারও তুলনামূলক বড়। আর ইউক্রেন এখনও জনবল ও অস্ত্র– দু’দিক থেকেই পিছিয়ে রয়েছে বলে জানাচ্ছেন ভাসিলি। ফ্রন্টলাইনে থাকার সময়কার একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘৮০০ মিটার দূরে শত্রু দেখলে আমি রেডিওতে বলি, ট্যাংক দেখছি, অবস্থান জানাচ্ছি। কিন্তু তারা বলে— ‘অপেক্ষা করো’। তখনই বুঝি, আসলে আঘাত করার মতো কিছুই আমাদের কাছে নেই।’
২০২৩ সালে ল্যান্ডমাইনে পা হারালেও ভাসিলি এখনো ইউক্রেনীয় বাহিনীতে দায়িত্বে আছেন। যুদ্ধকালীন নিয়মে তার নামের শেষ অংশ প্রকাশ করা হয়নি।
‘পুরোপুরি শেষ হবে— এমন আশাও করা যায় না’
সেনাবাহিনীর এক চার-তারকা জেনারেলের মতে, এই যুদ্ধে বাস্তবে যে অর্জনটা সম্ভব— তা হলো সংঘাতে কেবল একটি ‘বিরতি’। যুদ্ধটি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চম বছরে পড়বে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক উপপ্রধান ইহোর রোমানেনকো বলেন, ‘রাশিয়ার মতো আগ্রাসী প্রতিবেশী থাকলে যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আশা করা যায় না।’
তার মতে, ‘রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি তখনই আসবে, যখন আমরা ১৯৯১ সালের (সোভিয়েত-পরবর্তী) সীমান্তের ভেতরের সব ভূখণ্ড মুক্ত করব’। তিনি বলেন, যদি যুদ্ধবিরতির সেই বিরতি রাশিয়া ভেঙে দেয়, তাহলে কিয়েভকে ফ্রন্টলাইনে রুশ বাহিনীকে ঠেকাতে হবে এবং এজন্য সামরিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে।
রোমানেনকোর মতে, ইউক্রেনকে সার্বজনীন ও ‘ন্যায্য পন্থায়’ সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দিতে হবে— যেন কেউ ছাড় না পায়। পাশাপাশি দেশীয় অস্ত্র উৎপাদন বাড়াতে হবে, অর্থনীতিতে যুদ্ধের–প্রাধান্য দিতে হবে এবং কড়া সামরিক আইন চালু করতে হবে।
এই বছর ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা শিল্প দেশের সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনের ৪০ শতাংশ সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। ২০২২ সালে এই হার ছিল ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশ আসে পশ্চিমা সাহায্য থেকে এবং এই সহায়তা ‘দ্রুত ও আধুনিক’ হওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।
আরেক বিশ্লেষক বলছেন, যদি রাশিয়া ফ্রন্টলাইন ভেঙে দ্রুত অগ্রসর হতে না পারে এবং বুঝতে পারে কিয়েভ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়িষ্ণু যুদ্ধও সহ্য করতে পারবে— তাহলে ২০২৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধে শান্তিচুক্তির একটি ‘সুযোগ’ তৈরি হতে পারে। কিয়েভভিত্তিক পেন্টা থিংক ট্যাংকের প্রধান ভলোদিমির ফেসেনকো বলেন, সবকিছুই নির্ভর করবে ক্রেমলিন এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্ট পুতিন কতটা রাজি হন তার ওপর।
তার মতে, যুদ্ধ যদি আগামী বছর মস্কোর কাছে ‘অচল অবস্থা’ বলে মনে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষ দিকেই শান্তিচুক্তির আশা তৈরি হতে পারে। তবে পুতিন রাজি হলেও উভয় পক্ষের প্রস্তাব একসঙ্গে বসিয়ে সমন্বয় করতে কয়েক মাস লেগে যাবে।
ফেসেনকো আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইউক্রেনকে হয়তো দোনেস্ক অঞ্চলের কিয়েভ–নিয়ন্ত্রিত অংশ ছাড়তে হতে পারে, বিনিময়ে রাশিয়া পূর্ব ও উত্তর দিকের তিনটি অঞ্চল ছাড়বে। তা না হলে যুদ্ধ গড়িয়ে যেতে পারে ২০২৭ সাল পর্যন্ত।
বিশ্ব রাজনীতির বড় পরিবর্তন
কিয়েভভিত্তিক আরেক বিশ্লেষক ইহর তিশকেভিচ বলছেন, যুদ্ধের সম্ভাব্য শেষের ওপর বড় প্রভাব রাখছে বৈশ্বিক রাজনীতির পরিবর্তন। তার মতে, ২০২৬ সালে ‘সমষ্টিগত পশ্চিম’–এর ধারণাটাই বদলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ‘বৈশ্বিক পুলিশের’ ভূমিকা থেকে সরে আসবে এবং পশ্চিমা আধিপত্যের যুগ শেষের দিকে যাবে।
চীন বিশ্বমঞ্চে নিজ প্রভাব বাড়াচ্ছে তবে এখনও পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছে না। এতে গড়ে উঠছে এক ‘বহুমেরু’ বিশ্ব, যা আন্তর্জাতিক আইনকেও দুর্বল করে দেবে, আর এর প্রভাব পড়বে ইউক্রেনের অবস্থানের ওপর।
তিশকেভিচ বলেন, ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কা হলো ‘ফিনিশ মডেল’ বা ১৯৩৯ সালের ফিনল্যান্ড-সোভিয়েত যুদ্ধের মতো। সে যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনী বড় ক্ষতি সত্ত্বেও ফিনল্যান্ডের এক-দশমাংশ এলাকা দখল করে নেয় এবং ফিনল্যান্ড তা স্বীকার করে। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে এর মানে হবে— মস্কোর দখলে থাকা অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া।
তিনি আরেকটি সম্ভাবনাকে বলছেন ‘জর্জিয়ান মডেল’। ২০০৮ সালের রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধের উদাহরণ টেনে তিনি বলেছে, সেই মডেলে রাশিয়া দুটি অঞ্চলকে (দক্ষিণ ওসেটিয়া ও আবখাজিয়া) ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করে। এতে ইউক্রেন দখলকৃত অঞ্চল ফেরত পাবে না, তবে রাশিয়ার অংশ বলেও স্বীকৃতি দেবে না। তৃতীয় ‘মধ্যবর্তী’ পথ হলো— যুদ্ধ স্থগিত থাকবে, আর আলোচনা চলতে থাকবে।
জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিকোলাই মিত্রখিন বলছেন, যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত যেতে হলে একমাত্র দৃশ্যপট হলো ইউক্রেনকে দক্ষিণ-পূর্ব দোনেস্কের অবশিষ্ট এক-পঞ্চমাংশ এলাকা ছেড়ে দিতে হবে। সেটা স্বেচ্ছায় হোক বা বাধ্য হয়ে। একইসঙ্গে রাশিয়া জাপোরিঝিয়ার যে ৯০ শতাংশ ও দনিপ্রোপেত্রোভস্ক অঞ্চলের ১৫ শতাংশ দখলে রেখেছে, সেগুলোর ক্ষতিও মেনে নিতে হবে।
তার মতে, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ‘দুর্বল’, কারণ বহু দেশ এগুলো এড়িয়ে মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্য করছে। তাই অন্তত আরও দুই বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো সম্পদ আছে রাশিয়ার।
অন্যদিকে ইউক্রেনের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা আছে, কিন্তু ‘দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভীতু’ সরকার যথেষ্ট জনবল জোগাড় করতে পারছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। ফলে ইউক্রেন ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে আর পশ্চিমা মধ্যস্থতাকারীরাও রাশিয়াকে থামাতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন,, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা তার প্রশাসন হয়তো জেলেনস্কিকে দোনেৎস্ক ছাড়তে বাধ্য করবে অথবা যুদ্ধকালীন সময়েই নির্বাচন করতে বলবে। আর এতে করে ইউক্রেনের নেতৃত্বই বদলে যেতে পারে।’
এদিকে রুশ গোলাবর্ষণ, বিদ্যুৎঘাটতি ও অর্থনৈতিক চাপ— সব মিলিয়ে সাধারণ ইউক্রেনীয়রা ক্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। ৬৩ বছর বয়সী সাবেক অর্থনীতিবিদ তারাস তিমোশচুক বলেন, ‘দোনেৎস্কই ছিল আমাদের সমস্যার উৎস। ওটা রাশিয়ারই থাকুক— ওরাই তা পুনর্গঠনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ দিক। আমি চাই আমাদের পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙুক, রুশ ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দে নয়।’