শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১১ পৌষ ১৪৩২ | ৬ রজব ১৪৪৭

  • নিউজ ডেস্ক

    প্রকাশ :- ২০২৫-১২-২৬, | ১৯:০৩:৩২ |
রাজনীতিতে বাহন কখনোই নিছক যাতায়াতের মাধ্যম নয়- এটি অনেক সময় হয়ে ওঠে বার্তা, প্রতীক এবং কৌশলের অংশ। সাম্প্রতিক সময়ে বড় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় নেতাদের সুনির্দিষ্ট বাস ব্যবহার নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে এমন প্রশ্ন—কেন বাস, কেন এসইউভি/গাড়ি নয়, কেন খোলা ট্রাক নয়। 

বিশেষ করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এসইউভি, বিলাসবহুল গাড়ি, খোলা ট্রাক, পিকআপ বা ছাদে খোলা জানালাসমেত গাড়ি  সাধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। সম্প্রতি ১৭ বছর পর দেশে ফিরে তারেক রহমান বাস ব্যবহার করে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। তবে বিশ্ব রাজনীতিতে বাসের এমন ব্যবহার নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশে দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনি প্রচারণার কেন্দ্রীয় বাহন হিসেবে বাস ব্যবহৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের বিশেষ যানকে বলা হয় ‘ক্যাম্পেইন বাস’। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বা দলীয় প্রধানরা এই বাসে করে রাজ্য থেকে রাজ্যে ঘুরে বেড়ান। বাসের গায়ে থাকে স্লোগান, দলের রং ও বার্তা। ভেতরে থাকে মিডিয়া ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা, নিরাপত্তা টিম, কখনো কখনো ছোট বৈঠকের জায়গা। এমন বুলেটপ্রুফ বাস নেতাকে একদিকে যেমন জনগণের কাছে দৃশ্যমান করে, অন্যদিকে নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিত করে। 


বিশ্ব রাজনীতিতে বাস বহু আগেই কেবল যাতায়াতের বাহন নয়, বরং চলন্ত বা ভ্রাম্যমাণ রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হয়েছে। ইউরোপেও একই প্রবণতা বেশ জনপ্রিয়। টনি ব্লেয়ার থেকে শুরু করে অ্যাঞ্জেলা মেরকেল পর্যন্ত অনেক নেতাই প্রচারণায় বাসকে ব্যবহার করেছেন ভ্রাম্যমাণ রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে।

যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টি দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনি প্রচারণায় সুসজ্জিত ক্যাম্পেইন বাস ব্যবহার করে আসছে। ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে টনি ব্লেয়ারের লেবার পার্টির লাল রঙের বাস, যার গায়ে লেখা ছিল ' নিউ লেবার, নিউ ব্রিটেন', জনসংযোগ কৌশলের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। সাম্প্রতিক সময়েও লেবার নেতারা দেশজুড়ে সফরে একই ধরনের ব্র্যান্ডেড বাস ব্যবহার করেছেন। 

জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল নির্বাচনি প্রচারণার অংশ হিসেবে নীল-কালো রঙের সুরক্ষিত বাসে করে শহর থেকে শহরে গেছেন, যেখানে বাসটি একাধারে নিরাপদ যাতায়াত ও মিডিয়া সংযোগের কেন্দ্র ছিল। তুরস্কে রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান প্রায়ই বড় সাঁজোয়া বাস ব্যবহার করেছেন, যার ছাদ থেকে তিনি জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন-এটি শক্ত নেতৃত্ব ও জনসম্পৃক্ততার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। 

পাকিস্তানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার আন্দোলন ও নির্বাচনি প্রচারণায় বাসকে 'চলন্ত সমাবেশের মঞ্চে' রূপ দেন, বিশেষ করে লং মার্চের সময়। আর কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে সাধারণ বাস ও ট্রাকে ভ্রমণ করে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের বার্তা দিয়েছিলেন, যা তার গণমুখী রাজনীতির প্রতীক হয়ে আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

 এই প্রেক্ষাপটে বাস ব্যবহারের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- নেতার সর্বোচ্চ দৃশ্যমানতার কৌশল। বাস আকারে অনেক বড় ও উঁচু যা সহজে চোখে পড়ার মতো, বেশি নজর কাড়ে। বড় কোন নেতা যখন বাসে চলাচল করেন, তখন সেটি স্বাভাবিকভাবেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দ্বিতীয়ত, এটি একটি সুস্পষ্ট বার্তা বহন করে-‘আমি জনগণের মধ্যেই আছি।’ বাস এসইউভির মতো ব্যক্তিগত, জনবিচ্ছিন্ন বা অভিজাত বাহন নয়; এটি গণপরিবহনের প্রতীক। ফলে বাহন হিসেবে নেতা যখন বাস বেছে নেন, তখন সেটি রাজনৈতিকভাবে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকার ইঙ্গিত দেয়। এখানে জনবিচ্ছিন্নতা নয়, বরং দৃশ্যমানতাকেই সচেতনভাবে কৌশলে পরিণত করা হয়। 

তৃতীয়ত, আধুনিক বুলেটপ্রুফ বাস নিরাপত্তার দিক থেকেও কার্যকর। বাইরে থেকে এটি সাধারণ বাসের মতো দেখালেও ভেতরে থাকে শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থা, যা বড় নেতাদের চলাচলে ঝুঁকি কমায়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিত্রটি ঐতিহাসিকভাবে ভিন্ন। এখানে রাজনৈতিক সমাবেশ, মিছিল বা শোভাযাত্রায় খোলা ট্রাকই ছিল প্রধান বাহন। নেতারা ট্রাকে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন, হাত নেড়েছেন, স্লোগান তুলেছেন। ট্রাক হয়ে উঠেছে আন্দোলনের দৃশ্যমান প্রতীক। বাস ব্যবহৃত হয়েছে মূলত কর্মী পরিবহন বা বহরের অংশ হিসেবে, কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে নয়। অতীতে নির্বাচন বা লং মার্চে ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো বাস দেখা গেলেও সেগুলো ছিল সহায়ক, মূল নেতার বাহন হিসেব নয়। 

এই বাস্তবতায় যখন কোনো শীর্ষ নেতা ধারাবাহিকভাবে একটি নির্দিষ্ট বাস ব্যবহার করেন-বিমানবন্দর থেকে গণসংবর্ধনাস্থল, পারিবারিক সমাধিতে শ্রদ্ধা, জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাত্রা কিংবা হাসপাতালে অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়া—তখন সেটি আলাদা গুরুত্ব পায়। একই বাসের পুনঃপুন ব্যবহার একে কেবল পরিবহন নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতীকে পরিণত করে। এটি দেখায় যে নেতা তার চলাচল, দৃশ্যমানতা ও নিরাপত্তাকে একত্রে একটি পরিকল্পিত কাঠামোর মধ্যে আনতে চাইছেন। 

বাংলাদেশে এই প্রবণতা তাই তুলনামূলকভাবে নতুন। এটি পশ্চিমা ‘ক্যাম্পেইন বাস কালচার’-এর সরাসরি অনুকরণ না হলেও, এর মধ্যে আধুনিক রাজনৈতিক যোগাযোগ ও কৌশলের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। খোলা ট্রাকের আবেগী, উচ্চকণ্ঠ রাজনীতির পাশাপাশি এখানে দেখা যাচ্ছে নিয়ন্ত্রিত, পরিকল্পিত ও প্রতীকী দৃশ্যমানতার প্রয়াস। এতে রাজনীতির ভাষা বদলাচ্ছে-শুধু মঞ্চের বক্তৃতা নয়, চলাচলের ধরনও হয়ে উঠছে বার্তার অংশ।

সব মিলিয়ে বলা যায়, বড় নেতাদের বাস ব্যবহার একদিকে নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার বাস্তব প্রয়োজন মেটায়, অন্যদিকে এটি সচেতন রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। বাংলাদেশে এই প্রবণতা এখনও নতুন ও সীমিত হলেও, অতি সম্প্রতি তারেক রহমানের উদাহরণটি দেখিয়ে দিচ্ছে-নেতার বাহনের নয়া সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন



এ জাতীয় আরো খবর..
ইউটিউবে আমরা...
ফেসবুকে আমরা...