রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন মানবজাতির পাশাপাশি জিন জাতির জন্যও প্রেরিত নবী। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে উভয় সৃষ্টির কাছে আল্লাহ্র বাণী পৌঁছে দিয়েছেন।
ইবনু আব্বাসের (রা.) সূত্রে সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে, একসময় ফেরেশতাদের গোপন আলোচনা শোনার জন্য জিনরা কোনো বাধা ছাড়াই আকাশের কাছাকাছি নির্দিষ্ট এলাকায় যেতে পারত। কিন্তু শেষ নবীর (সা.) আগমনের সময় ঘনিয়ে এলে তাদের সেই পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঊর্ধ্বজগতে কঠিন নিরাপত্তাব্যবস্থা জারি করা হয়। কোন জিন বা শয়তান সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাকে উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দেওয়া হতো।
ঊর্ধ্বজগতে এই আকস্মিক পরিবর্তনের রহস্য উদঘাটনের জন্য জিনদের একটি প্রতিনিধি দল পৃথিবী সফরে বের হয়। পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ানো জিন দলটি তায়েফের কাছাকাছি নাখলা নামক এক প্রান্তরে এসে কুরআন তেলাওয়াত শুনতে পায়। সে সময় রাসুল (সা.) তায়েফ থেকে মক্কায় ফিরার পথে নাখলায় যাত্রা বিরতিতে সালাতুল ফজরের ইমামতি করছিলেন।
জিনরা কুরআন তেলাওয়াত শুনে সেখানেই থেমে যায়। ভোরের স্নিগ্ধ আলোতে ওহির বার্তাবাহক রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিমুগ্ধকর কন্ঠে কুরআনের তেলাওয়াত শুনে প্রতিনিধি দলটি সঙ্গে সঙ্গেই ইসলাম গ্রহণ করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৭৩)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, (হে রাসুল!) বলে দিন, আমার কাছে ওহি এসেছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে (কুরআন) শুনেছে অতঃপর (নিজ সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে) বলেছে, আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি। যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। সুতরাং আমরা তার প্রতি ইমান এনেছি। এখন আর আমরা আমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে (ইবাদতে) কখনও কাউকে শরিক করবো না। (সুরা জিন: আয়াত, ১-২)
প্রতিনিধি দলটি কেবল ইসলাম কবুল করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং তারা নিজেরাই দ্বীনের দায়ী হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন।
আল্লাহর ভাষ্যে, এবং (হে রাসুল) স্মরণ করুন, যখন আমি একদল জিনকে কুরআন শোনার জন্য আপনার অভিমুখী করে দিয়েছিলাম। যখন তারা সেখানে পৌঁছল, (একে অন্যকে) বলল, চুপ কর। তা পড়া হয়ে গেলে তারা আপন সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল সতর্ককারীরূপে। তারা বলল, হে আমাদের কওম! নিশ্চয় জেনে রেখ, আমরা এমন এক কিতাব (-এর পাঠ) শুনেছি, যা মুসা (আ.)-এর পর অবতীর্ণ হয়েছে, তার পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমর্থকরূপে, যা পথ-নির্দেশ করে সত্যের ও সরল পথের।
হে আমাদের কওম! আল্লাহর পথে আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দাও এবং তার প্রতি ইমান আন। আল্লাহ তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তোমাদেরকে রক্ষা করবেন এক যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি থেকে। (সুরা আহকাফ: আয়াত, ২৯-৩১)
জিনদের দ্বীনি শিক্ষা ও লাইলাতুল জিন
ইসলাম গ্রহণের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) জিন সম্প্রদায়কে দ্বীনি বিধিবিধান শিক্ষা দিতেন। বিভিন্ন সময়ে জিনেরা তার পবিত্র সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়ে শরিয়তের নানা হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করত।
যেসব রাতে রাসুল (সা.) জিনদের দাওয়াত দিয়েছেন বা জিনেরা তার কাছে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করতে এসেছে, ইসলামের ইতিহাসে সেসব রাত লাইলাতুল জিন নামে পরিচিত।
আমির (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আলকামাকে প্রশ্ন করলাম, জিনদের সঙ্গে সাক্ষাতের রাতে ইবনু মাসউদ (রা.) কি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে ছিলেন?
আলকামাহ (রা.) বললেন, আমি ইবনু মাসউদকে (রা.) জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, না। তবে আমরা এক রাতে রাসুল (সা.)-এর সাথে ছিলাম। হটাৎ আমরা তাকে হারিয়ে ফেলি। আমরা পাহাড়ি উপত্যকা ও গিরিপথে অনেক খোঁজ করেও তাকে পাইনি। আমরা মনে করলাম, হয় জিনেরা তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে অথবা কেউ তাকে গোপনে হত্যা করেছে।
ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন, সে রাতটি আমাদের জন্য এতই ভয়াবহ ছিল যে, এমন রাত কোন জাতির উপর এসেছে বলে মনে হয় না। ভোরে আমরা তাকে হেরা পর্বতের দিক থেকে আসতে দেখি। রাসুল (সা.) আমাদের জানান, জিনদের পক্ষ থেকে এক আহ্বানকারী তাকে নিতে এসেছিল। তিনি তার সঙ্গে গেলেন এবং তাদেরকে কুরআন পাঠ করে শুনালেন।
ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন, পরে তিনি আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যান এবং তাদের বিভিন্ন নিদর্শন ও আগুনের চিহ্ন দেখান।
জিনেরা তার কাছে খাদ্যের আবেদন করলে, তিনি বললেন, আল্লাহর নামে জবেহ করা প্রতিটি পশুর হাড় তোমাদের খাদ্য। তোমাদের হাতের স্পর্শে তা পুনরায় গোশতে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। আর উটের বিষ্ঠা তোমাদের পশুর খাদ্য।
অতঃপর রাসুল (সা.) বললেন, এ দুইটি বস্তু দিয়ে শৌচকার্য করো না। কেননা এগুলো তোমাদের ভাইদের (জিনদের) খাদ্য। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৯৩)
নাসিবাইন অঞ্চলে জিনদের সাক্ষাৎ
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, নাসিবাইন (সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যেবর্তী একটি নগরী।) অঞ্চল থেকে একদল জিন আমার কাছে এসেছিল। তারা ছিল ভালো জিন। তারা আমার কাছে খাদ্যদ্রব্যের আবেদন জানালে, আমি আল্লাহ্র কাছে দোয়া করলাম যে, যখন কোন হাড্ডি বা গোবর তারা লাভ করে তখন তারা যেন তাতে খাদ্য পায়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৮৬০)
রাসুলের তেলাওয়াতের জবাব
জাবের (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) তার সাহাবিদের সামনে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সুরা আর-রহমান পাঠ করলেন। কিন্তু সাহাবিরা নীরব থাকলেন। তিনি বলেন, এ সুরাটি আমি জিনদের সঙ্গে সামনে পাঠ করেছিলাম। তোমাদের তুলনায় তারা উত্তম জবাব দিয়েছিল। যখনই আমি তিলাওয়াত করেছি, “তোমরা জিন ও মানুষ, তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?”
তখনই তারা বলেছে, হে আমাদের রব! আমরা আপনার কোন নিয়ামতই অস্বীকার করি না, সমস্ত প্রশংসা আপনারই। (তিরমিজি, হাদিস: ৩২৯১)
রাসুল (সা.) বহুবার নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব জিন সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এতে মানব ও দানব উভয় জাতির জন্য তার নবুয়তের সার্বজনীনতা ও ব্যাপকতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
এ জাতীয় আরো খবর..