সৌদি আরবের মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারামের ইতিহাসের সূচনা পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের মধ্য দিয়েই। ইসলামী ইতিহাসের বর্ণনা অনুযায়ী, মানবজাতির আদি পিতা প্রথম মানুষ হজরত আদম আলাইহিস সালামের যুগেই কাবাঘর নির্মাণ করা হয়।
আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা জিবরাইল আলাইহিস সালামকে পাঠিয়ে আদম আলাইহিস সালামকে কাবা নির্মাণ এবং তার চারদিকে তাওয়াফ করার নির্দেশ দেন। তাকে জানানো হয়, তিনিই প্রথম মানুষ এবং কাবাই মানুষের জন্য স্থাপিত প্রথম ঘর।
কোরআনে এই ঘটনাকে মানবজাতির প্রথম ইবাদতকেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর স্থাপন করা হয়েছে, তা বাক্কায় অবস্থিত, যা বরকতময় এবং সারা বিশ্বের মানুষের জন্য পথনির্দেশক। (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ৯) বাক্কা হলো মক্কারই আরেক নাম।
সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত এক হাদিসে আবু জর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পৃথিবীতে প্রথম কোন মসজিদ স্থাপিত হয়েছিল। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মসজিদুল হারাম। এরপর কোনটি, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মসজিদুল আকসা। দুই মসজিদের মাঝখানে কত সময়ের ব্যবধান ছিল, জানতে চাইলে নবীজি জানান, চল্লিশ বছর। এরপর তিনি বলেন, পুরো পৃথিবীকেই তোমাদের জন্য মসজিদ বানানো হয়েছে; তাই নামাজের সময় হলে যেখানেই থাকো, সেখানেই নামাজ আদায় করো।
পরবর্তীকালে হজরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম মসজিদুল আকসা পুনর্নির্মাণ করেন। তবে তা কাবাঘর পুনর্নির্মাণের বহু বছর পরের ঘটনা, যা করেছিলেন হজরত ইবরাহিম ও তার পুত্র হজরত ইসমাইল আলাইহিমাস সালাম।
নুহ আলাইহিস সালামের যুগ
হজরত আদম আলাইহিস সালামের পর অনেক বছর কেটে গেলে পৃথিবীতে মহাপ্লাবন দেখা দেয়। এই ভয়াবহ বন্যায় কাবাঘর ধ্বংস হয়। তবে তার ভিত্তি অবশিষ্ট ছিল।
এই প্লাবন দেখা দেয় হজরত নুহ আলাইহিস সালামের যুগে। আল্লাহ অবাধ্যদের শাস্তি দিতে আকাশ থেকে প্রবল বৃষ্টি নামান এবং ভূমি থেকে প্রস্রবণ উদ্গীরণ করেন।
কোরআনে বলা হয়েছে, আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হলো প্রবল বৃষ্টিধারায়, আর ভূমিকে ফাটিয়ে দেওয়া হলো ঝর্ণাধারায়; নির্ধারিত এক উদ্দেশ্যে উভয় পানি একত্রিত হলো। (সুরা আল কামার, আয়াত : ১১-১২)
ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আগমন
এই মহাপ্লাবনে নুহ আলাইহিস সালামের নৌকায় রক্ষা পাওয়া অল্প কয়েকজন বিশ্বাসী ছাড়া প্রায় পুরো মানবজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর অনেক প্রজন্ম পরে মক্কায় আসেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। সে সময় কাবাঘরের কোনো দৃশ্যমান অবকাঠামো ছিল না। শুধু একটি ছোট উঁচু জায়গা তার ভিত্তিকে আড়াল করে রেখেছিল। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তার পুত্র হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন।
মুহাম্মদের (সা.) আগের সময়কাল
হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের জীবদ্দশায় কাবাঘরের তত্ত্বাবধান তার হাতেই ছিল। তার ইন্তেকালের পর এ দায়িত্ব পান তার ছেলে নাবিত। পরবর্তীকালে খুজাআ গোত্রের শাসনামলে আশপাশের এলাকায় মূর্তিপূজার বিস্তার ঘটে।
কাবায় মূর্তি
খুজাআ গোত্রের নেতা আমর ইবনে লুহাই মক্কায় কাবাঘরে প্রথম মূর্তি স্থাপন করেন এবং মানুষকে বোঝান যে এগুলো আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম। ধীরে ধীরে কাবা তাওয়াফ করতে আসা লোকজনও এসব মূর্তিকে ইবাদতে যুক্ত করে, ফলে ইবরাহিম ও ইসমাইল আলাইহিমাস সালামের একত্ববাদের শিক্ষা থেকে দূরে চলে যায় তারা। তবু কাবাঘরকেন্দ্রিক মক্কার মর্যাদা অটুট থাকে।
৪৪০ খ্রিষ্টাব্দে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চতুর্থ পূর্বপুরুষ কুরাইশ নেতা কুসাই ইবনে কিলাব মক্কার নেতৃত্ব গ্রহণ করার মাধ্যমে খুজাআ গোত্রের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর দীর্ঘ সময় কুরাইশদের মধ্যেই মূর্তিপূজা চলতে থাকে। অবশেষে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয় করলে এই নগরী শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে মুক্ত হয়।
মহানবীর (সা.) যুগ
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিভিন্ন হামলার কারণে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে কাবাঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তা মেরামত বা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। তবে প্রতিবারই তা নির্মিত হয়েছে হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল আলাইহিমাস সালামের স্থাপিত ভিত্তির ওপরই।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তপ্রাপ্তির আগে ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে কাবাঘরের একটি উল্লেখযোগ্য সংস্কারকাজ হয়। সে সময় তার বয়স ছিল ৩৫ বছর।
তখন মসজিদুল হারামের চারপাশে কোনো প্রাচীর ছিল না। চারদিকেই ছিল বসতবাড়ি, আর সেই বাড়িগুলোর মাঝের গলিপথ দিয়েই কাবাঘরে প্রবেশ করা হতো। ঘরগুলোর সঙ্গে কাবাঘরের মাঝখানের খোলা জায়গাটিই পরিচিত ছিল মাতাফ নামে।
মক্কা বিজয়ের দিন নবীজি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে কাবাঘরের ভেতরে ও চারপাশে স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তি ভেঙে ফেলেন।
মক্কা বিজয়ের পর নবীজির জীবদ্দশায় কাবাঘর বা মসজিদুল হারামে আর কোনো বড় ধরনের সংস্কারকাজ হয়নি। সে সময় মসজিদুল হারামের আয়তন ছিল আনুমানিক ১ হাজার ৪৯০ থেকে ২ হাজার বর্গমিটার।
নবীজির পরবর্তী সময়ে কাবাঘর
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে মসজিদুল হারামে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামল থেকেই মসজিদুল হারামের বড় পরিসরে সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজ শুরু হয়।
সূত্র : হজ এন্ড ওমরাহ প্ল্যানার
এ জাতীয় আরো খবর..